গৈ-গেরামের-পাঁচালি by আনসার উদ্দিন

আনসার উদ্দিনের গৈ-গেরামের-পাঁচালি   

গৈ-গেরামের-পাঁচালি  by  আনসার উদ্দিন


গৈ গেরামের পাঁচালি – শুধু একটি বই নয়, বরং এক দুয়ারযে দুয়ার দিয়ে আপনি ঢুকে পড়তে পারবেন গ্রাম বাংলার গরীবের হেঁশেল থেকে মেঠোপথে, দীন মজুরের পর্ণকুঠির থেকে গাজনতলার মাঠে। আর পেতে পারেন পচা পাটের সুগন্ধ – যা জাগিয়ে তুলতে পারে আপনার মণিকোঠার সব সুখ স্মৃতি। নারীর অন্তপুরের সব গোপন আলাপচারিতা আপনার মনে পুলক জাগাবে, আর মুসলিম নারীর অন্দরমহলের খবর জেনে আপনি বিস্মিত হবেন। লেপন দেওয়া মাটির চালাঘর, ঘর্ম-স্নাত সুখি মা-চাচী, ধর্মের বাঁধা না মানা সামাজিক রীতিনীতি, শীতের নকশি কাঁথা, বসন্তের মন হু-হু করা, ছায়াশীতল বটতলা, নবান্নর সু-ঘ্রান, এঁদো ডোবার পাশে কিশোরের কল্পনার জগৎ ইত্যাদি সব আশ্চার্‍্য জগতে ঘুরিয়ে আনবে এই বই গৈ গেরামের পাঁচালি। এখন পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে কি এই সব রূপ আর নেই? আছে। কিন্তু তার বিস্তর পট পরিবর্তন ঘটেছে, সেই পট পরিবর্তনের চিত্রও ধরা পড়বে পাঠকের কাছে গৈ গেরামের পাঁচালির দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করলে।   

গৈ-গেরামের-পাঁচালি
দুঃখের খাতা খুলে সুখের সন্ধান করে মন –

শুধু কি সুখের চিত্র এঁকেছেন আনসার উদ্দিন? না, এই বইয়ের পাতায় পাতায় রয়েছে এমন সব বেদনার ছবি যা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করবেই। কঠোর সংগ্রামে নিজ জীবন ও পরিবারকে টিকিয়ে রাখা ক্ষেত মজুরের কথা, গ্রাম্য রাখালদের বেদনা-বিদুর কাহিনী, বাংলার ঘরে ঘরে চির-দুঃখিনী মায়েদের কথা আনসার উদ্দিনের কলমে জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। লেখকের নিজ মায়ের জীবন সংগ্রাম যেন বাংলার সব দুঃখিনী মায়ের সংরামের প্রতীক। লেখকের কলমে শোনা যাক –

“আমাদের এক গোয়াল গোরু ছিল।...তিন চারটে রাখাল ছিল। সকালে গোয়াল ঘর থেকে গোরু বের করে পাতনায় বেঁধে দিলে গোয়াল পরিষ্কার করা হত। এই নির্দিস্ট কাজটা আমার মাকে করতে হত। শুধু গোয়াল পরিষ্কার নয়, ছট-বড় চল্লিশটা গোরু-মোষের পাতনায় পানি ঢালতে হত। পাতনা গুলো পরপর সাজানো ছিল। উঠোনের একটেরে ছিল সাবেক কালের ইঁদারা। মা শাড়ির আঁচল কোমরে জড়িয়ে ঘড়া বালতি ডুবিয়ে বেলাভর পানি তুলত। পানি তোলা তো নয়, যেন ইঁদারার সাথে যুদ্ধ করা।

শুধু আঠারো বিশটা পাতনা জলে ভরলেই শেষ নয়। বালক আনসার লক্ষ্য করত বেদনার্ত অসহয়তার চোখে যে, বাড়ির তাবৎ পুরুষদের নাওয়ার জন্য ইঁদারা থেকে হাজার বালতি পানি তুলতে হত। আমার চাচারা অকাতরে বালতি বালতি পানি ঢেলে রাতের অপবিত্র শরীরকে পাক সাফ করে নিত। ইঁদারা চত্বর সেই নোংরা ময়লা পানি হড়হড়িয়ে বাড়ির গর্তে নেমে যেত। মায়ের মাথাটা আবার ইঁদারার মধ্যে। তাঁর হাতের দড়ি ততক্ষণে গভীর পাতালে পৌঁছে গেছে। মাকে এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একনাগাড়ে পানি তুলতে দেখেছি। দেখেছি তাঁর দুচোখের পানি দীঘল দড়ি বেয়ে অতল পাতালের দিকে নেমে যেতে। 

গৈ-গেরামের-পাঁচালি
মুসলিম নারীদের অন্দরমহলের কথা –

গ্রাম সমাজের মুসলিম নারীদের জীবন যাত্রার খুঁটিনাটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে গৈ গেরামের পাঁচালির ‘গ্রামের মুসলিম নারী সমাজ’ অধ্যায়ে। এই চিত্রায়ন যে কতটা গভীর তার একটা আভাস পাওয়া যায় বইটির অন্যতম সম্পদ সুধীর চক্রবর্তীর অতীব সুখপাঠ্য ‘ভূমিকার বদলে’ অংশে। যেখানে তিনি লিখেছেন –

“সে বার ঘুরতে ঘুরতে রটন্তী গাঁয়ে গিয়ে পড়েছিলাম। গাঁয়ের যুবকরা আমাকে দেখাল এক মধ্য বয়সী নারীকে, যার গ্রাম নাম নপিচাচী। কালো কিষ্টি গাত্রবর্ন, মুখে মেছেতার দাগ, পানখাওয়া দাঁত আতার বিচি, অকাল প্রৌঢ়, ঊধ্বার্ঙ্গে ছাপা শাড়ির গোঁজামিল আব্রু। যুবকেরা আমাকে শোনানোর জন্য জিজ্ঞাসা করল, ‘ও চাচী তোমার বেলাউজ কোথায় গেল?’ নপিচাচী একগাল হেসে বলল, ‘ আর বেলাউজ! শাদির রাতে লাল টুকটুকে একখান ডেকরনের বেলাউজ এই অঙ্গে উঠেছিল। তারপরে চোপর দিন খাটনি, পানি তোলা, ঢেঁকি চালান, অম্বল গ্যাস সাদা সেরাব। তারই মধ্যে হেলাজ, বেলাল, হেনা, তহমিনা, ফারুক, তাহেরুদ্দিন একে একে জন্মাল। কখন যে সেই বেলাউজের রং গেল চটে, ছিঁড়ে ফেটে কোথায় চলে গেল তার কি উদ্দেশ্য আছে বাপ সকল?”   

গৈ-গেরামের-পাঁচালি
হারিয়ে যাওয়া সোনা মানিক –


  যে বুনবে কেলে,

  সে পুষবে মাগ ছেলে।

  যে বুনবে মুদো,

  তার ছেলে হবে কুঁদো ... কোথায় সে কেলে আউস ধান? কালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া এমন বেশকিছু জিনিসের সন্ধান দিয়েছেন আনসার উদ্দিন তাঁর গৈ গেরামের পাঁচালিতে। লেখকের স্মৃতি মেদুর মন আর খুঁজে বর্তমানে আর পায়না সাবেকি কেলেসোনা, হেতে মাউরি, রাঙিমল, খঞ্জরমনি, ব্যানামুড়ি ইত্যাদি সব ধানের সন্ধান। এখনকার কেউ কি জানে নিড়ানির এত বাহারি নাম, যেমন- কলমিলতা, চাঁদাপাতা, বেলপাতা, ওকোলচাঁদা আর নানা রকমফেরে তাদের কাজ। পাল্টে গিয়েছে মানুষের খাদ্যাভাস আর কর্মাভ্যাস। চাষি বউকে এখন আর ধান ভাঙতে, বাটনা বাঁটতে, জল আনতে হয় না। এখন গুড়ো মশলার যুগ, এত সুখেও অশান্তি আর কাটেনা। লেখক তাঁর বিহারী কাকাকে প্রশ্ন করেন, কাকা এখনকার ছেলে মেয়েরা বাপ-মাকে ভাত দেয়না কেন?

সহজ-সরল অথচ গভীর দর্শন জ্ঞানী বিহারী কাকা উত্তর দেন- কি করে দেবে?আজকাল সন্তাম প্রসব হয় তো অজায়গা দিয়ে!

এই বিহারী কাকা কথায় কথায় ডাক্তারের কাছে ছুটে মুঠো মুঠো ওষুধ গিলতে নারাজ। তিনি গুনকীর্তন করে চিরাচরিত ভেষজের –

শিরঃপীড়ার মহৌষধ ওলটকম্বলের ডাঁটি 

সর্বপ্রকার আমাশয়ে থানকুনি খাঁটি ।

পেটেতে কৃমি হলে চিরতার জল

ফোঁড়া ফাটাতে লাগে পায়রার মল।

অনিদ্রার রুগি খাবে শুষনির শাক

কামশক্তির শিমূল শিকড় নাই রাখ ঢাক।

ন্যাবা হলে কাঁচা হলুদ ইক্ষুর গুড়

চোখ ওঠা নিরাময়ে লাগে হাতি শুড়।

গৈ-গেরামের-পাঁচালি
রাখাল ছেলে রাখাল ছেলে বারেক ফিরে চাও –


  আমি হলেম গোরুর রাখাল মাঠে মাঠে থাকি

  বাঁশরি বাজাইয়া বন্ধু পালের গোরু ডাকিরে –

  প্রাণ কান্দে তুমার লাইগ্যা গো...

রাখাল জীবনের এমন সম্পুর্ন তথ্যবহুল আলেখ্য আপনি খুব কমই পাবেন যেমন আনসার উদ্দিন লিখেছেন তাঁর মাঠের রাখাল অংশে। রাখালদের কত রকমফের – পেটেভাতে রাখাল, বাঁইয়া রাখাল, কান্ধি রাখাল, মোড় রাখাল ইত্যাদি। মোড় রাখাল হল রাখাল রাজা – রাখালদের সমাজের সবথেকে সম্মানজনক পদ। একজন কিশোর শারীরিক সামর্থ্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে মোড় রাখালের অধীনে গোরু চরানোর অধিকার পায়। আর এই পরীক্ষা হল তাঁর পিঠে জোরে কিল মারা বা কাঁধে জোরে চিমটি কাটা। এমনসব খুঁটিনাটি বিবরনের সাথে আনসার উদ্দিন দিয়েছেন রাখালদের মনের নানা খবরও। পড়তে পড়তে আপনি যেন কখন ফিরে যাবেন ফেলে আসা সেই সব দিনগুলিতে। আপনার মন জুড়ে যাবে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ঘাসের মাঠে, রাখালের প্রাণ কাড়া বাঁশির সুরে, শীতের নরম রোদের দুপুরে।   

আনসার উদ্দিন
লেখক পরিচিতি - আনসার উদ্দিনের জন্ম ১৯৫৯ সালে নদীয়ার নাকাশিপাড়া থানার শালিগ্রামে, বর্তমানের ন’পাড়ায়। পেশায় প্রান্তিক চাষি। লেখায় ধরা পড়ে গ্রাম বাংলার সুগন্ধ আর মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষের সুখ দুঃখের নানা কথা। ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘আনসার উদ্দিনের গল্প-সংগ্রহ’। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। তাঁর লেখা অন্যান্য বই হল – গো-রাখালের কথকতা, জন-মুনিষ, হেঁশেল জীবন, মাটির মানুষ মাঠের মানুষ, জীবনের কথা যাপনের কথা ইত্যাদি। আনসার উদ্দিনের প্রিয় লেখক সুবোধ ঘোষ। 

Note - একাধিক গবেষণায় প্রমানিত হয়েছে যারা নিয়মিত বই পড়েন তাদের গড় আয়ু বৃদ্ধি পায়। বই পাঠ মানুষকে সুখি করে তোলে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর আপনার নিজস্ব লাইব্রেরির নিভৃতে পছন্দের বই পড়ার সুখে ডুবে যাওয়া – এক পরম বা স্বর্গীয় শান্তির ব্যাপার। এ এক এমন জিনিস যা আপনার মানসিক প্রশান্তিকে উচ্চ স্তরে পৌঁছে দেয়। আপনার শারীরও সেই সুখের আবেশে অনেক সুস্থ-সবল হয়ে ওঠে। এই যে দেহমনের সুখানুভূতি আপনার শরীরের কোশের অন্তরতম স্থানে পৌছায় – যা একটি পরিপূর্ন সুস্থতা দান করে। তাই দীর্ঘদিন সুস্থ থাকার জন্য বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা একান্ত জরুরী। এই প্রয়াসকে স্বার্থক করে তোলার জন্য ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন বই সম্পর্কে আলোচনা শুরু করা হল।

আরও পড়ুন 👉 ঘোড়া নিয়ে লিখিত বিশ্ব সাহিত্যের অমর তিন রচনা। 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.