জীবনের ঝরাপাতা’ এক বালিকার পূর্ণ নারী হয়ে ওঠার এক অনুপম রচনা।
সরলা দেবী চৌধুরানী-র আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’ এক বালিকার পূর্ণ নারী হয়ে ওঠার এক অনুপম রচনা। আত্মকথন ছাড়াও সমকালীন দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অনবদ্য সব ঘটনা বিবৃত হয়ে আছে এর পাতায় পাতায়।ভূমিকা - কোন ব্যাক্তির স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী বইপোকাদের কাছে সর্বদাই সুখপাঠ্য। লেখক এখানে সরাসরি নিজের জীবনের সুখদুঃখের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন বলে পাঠক তার সাথে একাত্ম বোধ করে। তাছাড়া একজন মানুষের ফেলে আসা জীবনের নানা স্মৃতির সাথে সাথে কত অজানা ঘটনা, সামাজিক রীতিনীতি, কতনা অচেনা মানুষের কথা এতে ধরা দেয় – যা আমারা সাধারণ বইতে কখনোই পাইনা। আর সেই আত্মজীবনী যদি কোন বিখ্যাত মানুষের হয় তাহলে তার আবেদন আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
ভারত ইতিহাস প্রসঙ্গ - সরলা দেবী চৌধুরানী (১৮৭২-১৯৪৫)-র ‘জীবনের ঝরাপাতা’ তে ভারত ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ের কথা ধরা হয়েছে। লেখিকা যেহেতু ছিলেন একজন উচ্চ শিক্ষিত ও ভারত বিখ্যাত পরিবারে কন্যা, তাই তৎকালীন সময়কার ইতিহাসের উপাদান এর জন্য এই আত্মজীবনী যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ন। জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ও তার কার্যকলাপ, গান্ধির অহিংস আন্দোলন ও তার সাথে সাথে বাংলার যুব সমাজের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রসারের নানাকথা ও বহু অজানা তথ্য এতে লিখিত হয়েছে। সেদিক থেকে দেখলে ‘জীবনের ঝরাপাতা’ এক অসামান্য দলিল।
সমকালীন মনীষীদের প্রসঙ্গ - সমকালীন ভারতের বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য ব্যাক্তির সাথে লেখিকার ঘনিস্ট পরিচয়ের কথা তার আত্মজীবনীতে উল্লেখিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (লেখিকার মাতুল), মহাত্মা গান্ধী, স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, তিলক, অ্যানি বেসান্ত প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এইসব প্রাত স্মরনীয় ব্যাক্তিদের সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য আমরা ‘জীবনের ঝরাপাতা’ থেকে জানতে পারি।
মা ও সরলাদেবী – লেখিকার মা ছিলেন স্বনামধন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫ ১৯৩২)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বোন ছিলেন একজন নামকরা লেখিকা এবং দীর্ঘদিন ‘ভারতি’ প্রত্রিকার সম্পদনা করেছেন। মায়ের সাথে লেখিকার সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। প্রথম জীবনে মায়ের আদর তিনি খুব একটা পাননি বলে মায়ের প্রতি বুকভরা অভিমান ছিল। তিনি লিখেছেন মা তাঁর নির্দিস্ট গণ্ডির মধ্যে থাকতেন, আভিজাত্যের অহঙ্কার তাঁর মায়ের প্রবল ছিল ঠাকুর বাড়ির আর সব মেয়েদের মত – ফলে লেখিকা মায়ের কাছে তেমন পাত্তা পেতেন না। বাড়ির দাসীদের কাছে মানুষ হয়েছেন। এরকম জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির অন্দমহলের নানা প্রসঙ্গ লেখিকা বইটিতে তুলে ধরেছেন।
মাতুল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – কবিগুরু ছিলেন লেখিকার মামা, তবে তাঁর সাথেও সম্পর্ক খুব একটা যে সুবিধার ছিল তা নয়। সরলার প্রবল আত্মসচেতনতা, সমকালীন নারীদের গণ্ডি পেরিয়ে পুরুষের ন্যায় কর্মজীবনে যোগদান আরো কিছু বিষয় তাঁর মাতুলের মনঃপূত ছিলনা। সরলা যে প্রতাপাদিত্যকে ‘বাংলার শিবাজী’ আদর্শে তুলে ধরে ছিলেন তাতে বেজায় চটেছিলেন বিশ্বকবি। কারণ, কবির ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ এ চিত্রিত প্রতাপাদিত্য এর বিপরীত ছিল।এছাড়া সরলার কাশীর মন্দিরে গমণ, সন্ধ্যা আরতি দর্শণ ইত্যাদি তিনি পছন্দ করেন নি। এমন কিছু ছোট খাট বিষয়ে উভয়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সরলা মাতুল কে অশ্রদ্ধা করতেন এমন নয়, কবির প্রথম জন্মদিন তিনিই প্রথম পালন তা এই বইতে তিনি জানিয়েছেন।
স্বামী বিবেকানন্দ ও সরলাদেবী - স্বামী বিবেকানন্দ এর সাথে সরলা দেবীর ঘনিস্ট পরিচিতির কথা এই বই তে বিবৃত হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ যে তাঁকে খুবই পছন্দ করতেন এবং নিজের কর্ম জীবনের সাথে সরলাকে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিবেদিতার কাছে জানিয়েছিলেন – সরলার শিক্ষা স্বয়ং সম্পূর্ণ। কিন্তু কোন এক অজানা সঙ্কোচে সরলা দেবী সে ডাকে সাড়া দিতে পারেননি।
কর্মজীবন – কর্মবহুল জীবনের অধিকারী ছিলেন সরলা দেবী। জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নেওয়া, সাহিত্য রচনা, পত্রিকা সম্পাদনা, নারী হয়েও সেই সময়ে বাংলার বাইরে গিয়ে মহীশূরের মহারানী গার্লস স্কুলে পড়ানো, ইন্দোরের মহারাজার উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন, সংগীত সাধনা,কবিগুরুর অনেক গানে সুর প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি অনন্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ‘বন্দেমাতরম’ এর যে সুর আমরা রবীন্দ্রনাথের বলে জানতাম, কিন্তু তার যে প্রথম দুটি চরণই মাত্র রবীন্দ্রনাথের, বাকীটুকু সরলা দেবীর – সে খবর আমরা ‘জীবনের ঝরাপাতা’ থেকে পাই।
সরলা দেবী বাংলার যুবসমাজকে জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষা দেন ও তাদের মধ্যে স্বদেশ প্রেমের ভাব জাগিয়ে তোলেন। এজন্য তিনি বীরাস্টমী প্রথা, প্রতাপাদিত্য এবং উদায়াদিত্য উৎসব পালন করে তাদের অতীত গৌরবের কথা তুলে ধরেন। স্বদেশী দ্রব্যের প্রচার ও বাংলার বিধবাদের উন্নয়নের কথা ভেবে তিনি ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন – সেখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করে আনা দ্রব্য বিক্রয় করা হত।
বিলুপ্ত প্রথা ও রীতি নীতি - পাঠক বেশকিছু প্রথা ও রীতি নীতির সন্ধান পাবেন এই অনবদ্য আত্মজীবনী পাঠ করে। তখনকার মেয়েরা একে অপরে সই পাতিয়ে সুন্দর সুন্দর সব নাম দিত সেই বন্ধুত্বের। যেমন, ‘বকুলফুল’, ‘জ্যোৎস্নারাত’, ‘মিস্টিহাসি’ ইত্যাদি। যা জেনে যে কোন পাঠকই অবাক হবেন যে এমন প্রথা আমাদের পূর্বকালীন সমাজে প্রচলিত ছিল। কি সুন্দর লাগে সমকালীন বালক বালিকা ও কিশোর কিশোরীদের জীবন যাত্রা কেমন ছিল পড়ে জানতে। একটি অপূর্ব সুন্দর ছড়া বইতে দেওয়া হয়েছে । কিশোরিরা ঘুটি খেলত আর এই ছড়া কাটত –
“ও দোলন দোলন ও দোলনটি
এক তুলব দোলের নোটনটি
নোটনধাম নোটনধাম নোটনধামটি”
কি সুন্দরই ছিল তখনকার বালক বালিকা ও কিশোর কিশোরীদের জীবন। সরলা দেবী আরো লিখেছেন, ঠাকুর বাড়ির মেয়েদের গঙ্গা স্নান করার কথা। পর্দা প্রথা ও পরপুরুষদের সামনে নারীদের বার হওয়ার ব্যাপারটি এতই কড়া ছিল যে, ঠাকুর বাড়ির মেয়েদের গঙ্গা স্নানের ইচ্ছা হলে তাদের পালকি করে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হত এবং সেখানে পালকি শুদ্ধ জলে চুবিয়ে স্নান করানো হত!!
বাবা ঠক্কর বা অটল খাঁর কাহিনী – সরলা দেবীর স্বামীর পূর্বপুরু ষ দের আদি নিবাস ছিল হিমালয়ের পাদদেশ গুরুদাস পুরের কঞ্জরুর-এ। ওই কঞ্জরুর-এর দত্তরা ছিল বীরপুরুষের জাত, যুদ্ধে প্রান দেওয়াটা ছিল তাদের কাছে অতি সাধারণ ব্যাপার। সরলা দেবী লিখেছেন, “কঞ্জরুর দত্তদের এক পূর্বপুরুষ আততায়ীর বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে শহীদ হয়েছিলেন। তাঁর নাম বাবা অটল খাঁ। কঞ্জরুরে তাঁর সমাধি অবস্থিত, একটা মাতির ঢিবি, অনতিউচ্চ মাটির দেওয়ালে ঘেরা। সন্ধ্যা হলে আশেপাশের গ্রাম থেকে হিন্দু-মুসলমান উভয় শ্রেণীর স্ত্রী-পুরুষেরা আসে। সমাধির ওপরে নিজের নিজের দীপ জ্বালায়”। লেখিকাও সেখানে যান । দেখেন মাটির প্রাচীরটি প্রতি বছর বর্ষাকালে ধুয়ে ভেঙ্গে যায়। তাদের অনুরোধে সরলা দেবী ইটের পাকা গাঁথুনি করে দেন।
মিরাসি প্রথা - সরলা দেবী তাঁর শ্বশুড় বাড়ির বর্ননায় মিরাসিদের উল্লেখ করেছেন। কঞ্জরুর এলাকার অনেক বংশে, বংশের গুনগান গাওয়ার জন্য কীর্তিগায়ক নামে মিরাসিরা ছিল স্কচ Pipers দের মত। ভাট কবি নয় তারা। এই ব্রাহ্মন মিরাসিরা পরবর্তিতে মুসলমান প্রভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে। বিবাহ বা অন্য পারিবারিক অনুষ্ঠানে সমাগত অতিথিরা যখন খেতে বসত তখন মিরাসিরা পূর্বপুরুষদের কীর্তিকলাপ গাইতে থাকত। শুনতে শুনতে গর্বে শ্রোতাদের বুক ফুলে উঠত। যজমানদের সেই অতীত গৌরববাহী বানী মিরাসিদের বংশ পরপরম্পরাগত খাতায় ভরা থাকত, যা ভোলার বা অপলাপ হবার জো ছিল না।
‘মেয়েরা হবে নরম শরম’ – প্রচলিত এই ধারনার বাইরে বেরিয়ে সরলা দেবী সমকালীন সমাজ সংসারে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছিলেন শুধুমাত্র নিজ ব্যাক্তিতের জেরে। হয়ত তিনি এক আলোকপ্রাপ্ত পরিবারের কন্যা ছিলেন, কিন্তু তখন মেয়েদের সমাজ যথেষ্ট অন্ধকারে ভরা ছিল। তাই তাঁর এই আত্মজীবনী যে কোন আত্মসচেতন নারীর কাছেই এক দৃষ্টান্ত স্বরুপ।
Note - একাধিক গবেষণায় প্রমানিত হয়েছে যারা নিয়মিত বই পড়েন তাদের গড় আয়ু বৃদ্ধি পায়। বই পাঠ মানুষকে সুখি করে তোলে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর আপনার নিজস্ব লাইব্রেরির নিভৃতে পছন্দের বই পড়ার সুখে ডুবে যাওয়া – এক পরম বা স্বর্গীয় শান্তির ব্যাপার। এ এক এমন জিনিস যা আপনার মানসিক প্রশান্তিকে উচ্চ স্তরে পৌঁছে দেয়। আপনার শারীরও সেই সুখের আবেশে অনেক সুস্থ-সবল হয়ে ওঠে। এই যে দেহমনের সুখানুভূতি আপনার শরীরের কোশের অন্তরতম স্থানে পৌছায় – যা একটি পরিপূর্ন সুস্থতা দান করে। তাই দীর্ঘদিন সুস্থ থাকার জন্য বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা একান্ত জরুরী। এই প্রয়াসকে স্বার্থক করে তোলার জন্য ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন বই সম্পর্কে আলোচনা শুরু করা হল।
আরও পড়ুন 👉 গৈ-গেরামের-পাঁচালি by আনসার উদ্দিন।
বইটির বর্তমান প্রকাশক - দে'জ পাবলিশিং। মুদ্রিত মূল্য - ২৫০ টাকা।
Please do not enter any spam link in the comment box