🍾 মহাত্মা ক্রিস্টিয়ান ফেড্রেরিখ স্যামুয়েল হ্যানিমানের হাত ধরে পরিচিত হওয়ার ২০০ বছর পরও সারা বিশ্বে বহুল পরিমানে জনপ্রিয় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। অনেক খ্যাতিমান ব্যাক্তিও এই চিকিৎসার গুণগ্রাহী। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থ হল Organon of Medicine, যে সমস্ত হোমিওপ্যাথ Organon of Medicine এর মতানুসারে চিকিৎসা করেন, তাদের হাতে অনেক বহু পুরাতন জটিল রোগও আশ্চর্যজনকভাবে মন্ত্রের মত ভালো হয়ে যায়। আবার অনেকে এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে আস্থা রাখতে পারেন না। তাই আজ আমরা Notepage এর কলমে এই চিকিৎসা পদ্ধতির মূল ভিত্তি এবং এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় পেতে চেষ্টা করব।
হোমিওপ্যাথি কি? (What is Homoeopathy?) -
স্যামুয়েল হ্যানিমান আবিষ্কৃত হোমিওপ্যাথির মূল সূত্র হল “Similia Similibus Curantur” অর্থাৎ “likes are cured by likes” অর্থাৎ সমতাবিধান অনুসারে চিকিৎসা করা। যেমন, আমরা জানি পেঁয়াজ কাটার সময় আমাদের চোখ জ্বালা করে ও চোখ দিয়ে জল ঝরে বা আলার্জি এর মত অবস্থা সৃষ্টি হয়, এখন যদি কোন ব্যাক্তির সাধারণ সর্দিতে ওই রকম অবস্থার সৃষ্টি হয় তবে পেঁয়াজ থেকে তৈরি হোমিওপ্যাথিক ওষুধ Aleum Cepa প্রয়োগ করা হয়, তাহলে সেই ব্যাক্তি আরোগ্য লাভ করে। তবে, তাঁর সর্দির লক্ষণ সাধারণ মানুষের পেঁয়াজ লাগলে যেরকম হয় তেমন থাকতে হবে, তবেই আরোগ্য সম্ভব হবে, নতুবা নয়। একেই বলে সমতা বিধান অনুসারে চিকিৎসা করা – যা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার মূল নীতি।
হোমিওপ্যাথির ইতিহাস (History of Homoeopathy) –
হ্যানিমান পর্যবেক্ষণ করেন সিঙ্কোনার (কুইনাইন) প্রয়োগ করে যেমন ম্যলোরিয়া জ্বরের উপশম হয়, তেমনি সুস্থ শরীরে যদি নিয়মিত সিঙ্কোনা প্রয়োগ করা হয় তবে আশ্চর্যজনকভাবে তার দেহে ম্যালোরিয়ার মত রোগ লক্ষণ ফুটে ওঠে!!! - এই ব্যাপারটি তাঁকে ভাবিয়ে তোলে এবং মাথায় দারুণ এক আইডিয়ার জন্ম দেয়। তিনি ভাবলেন একইভাবে অন্যান্য ওষুধ সুস্থ মানুষের দেহে প্রয়োগ করলে কি কি লক্ষণ ফুটে ওঠে দেখা যাক। এরপর তিনি নানারকম ভেষজ গাছ, খনিজ পদার্থ, সাধারন পদার্থ (যেমন বালি, কাঠ কয়লা, সোনা ইত্যাদি) এমনকি বিভিন্ন রোগবীজ খুব অল্প পরিমানে নিয়ে শক্তিকৃত করে সুস্থ দেহে প্রয়োগ করে কি শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ ফুটে ওঠে তা লিপিবদ্ধ করা শুরু করেন। একে বলে ওষুধ Proving করা। এরপর তিনি রোগীদের দেহ ও মনের লক্ষণের সাথে তার Proving করা ওষুধের লক্ষণ মিলিয়ে প্রয়োগ করে অভাবনীয় ফলাফল পেলেন। অনেক রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলো—এভাবেই হোমিওপ্যাথির পথ চলা শুরু হয়। তবে হ্যানিমানের আগে থেকেই সদৃশ পদ্ধতিতে চিকিৎসা হত বলে অনেকে মনে করেন, তখন অত জনপ্রিয় ছিলনা। হ্যানিমানই এটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
হোমিওপ্যাথির মূলনীতি (Treat the patient, not the disease)
মহাত্মা হ্যানিমান হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানের আর এক মৌলিক গ্রন্থ Meteria Medica বইতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য এর কথা উল্লেখ করেছেন। যথা –
(১) রোগীর রোগ নির্ধারন করা,
(২) তাকে পুর্বের সুস্বাস্থ্যে প্রতিষ্ঠা করা এবং
(৩) রোগিকে সম্পুর্নভাবে আরোগ্য বিধান করা।
এটা ছাড়াও ওই গ্রন্থে এই চিকিৎসা শাস্ত্রের নীতি, আদর্শ এবং পদ্ধতি উল্লেখ রয়েছে, যা থেকে আমরা জানতে পারি Homoeopathy হল সম্পুর্ণ লক্ষণ ভিত্তিক চিকিৎসা। চিকিৎসক প্রথমে রোগীর রোগ লক্ষণ লিপিবদ্ধ করেন। এই সময় তিনি সর্বদা রোগীর আত্মিক-মানসিক,বিরল বা অদ্ভুত কি কি লক্ষণ তার দেহে দেখা যাচ্ছে সেগুলির ওপর জোর দেন। কারন তার কাছে রোগীর রোগফলের গুরুত্ব কম, বিশেষত ওষুধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে। Homoeopathy তে একটি কথা বহুল প্রচলিত, “Treat the patient, not the disease.” অর্থাৎ রোগের নয় রোগীর চিকিৎসা করতে হবে।
হোমিওপ্যাথি অনুসারে রোগের কারন নির্নয় –
হোমিওপ্যাথিতে রোগ ফলের থেকে রোগের কারনের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। যেমন কোন ব্যাক্তির হয়ত চর্মে কোন উদ্ভেদ সৃষ্টি হয়েছে, হোমিওপ্যাথি অনুসারে ওই চর্মের উদ্ভেদের ওপর কোন ওষুধ প্রয়োগ না করে ওই উদ্ভেদ কি করে সৃষ্টি হল তা নির্নয় করে এবং লক্ষণ অনুসারে ওষুধ নির্বাচন করে দেহের Vital Force কেই তা উজ্জীবিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়, যাতে Vital Force নিজেই ওই উদ্ভেদ সারিয়ে নিতে পারে। অর্থাৎ ওষুধ দিয়ে রোগ সারানোর কথা বলা হয় না। তাছাড়া হোমিওপ্যাথিতে রোগের সৃষ্টির জন্য ৪ রকম রোগবিষ বা Maism এর কথা বলা হয়।
যেমন –
১, সোরা রোগবিষ (Psora Maism)
২, সাইকোসিস রোগবিষ (Sycosis Maism)
৩, সিফিলিটিক রোগবিষ (Syphilis maism) এবং
৪, টিউবারকুলার রোগবিষ (Tubarcular Maism)
- এই সমস্ত রোগবিষের এক একটির এক এক রকম চরিত্র এবং এর অন্তর্গত রোগের এক এক রকম চরিত্র লক্ষণ রোগীর দেহে ফুটে ওঠে – সেই অনুসারে চিকিৎসক ওষুধ নির্বাচন করে থাকেন।
হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রয়োগ পদ্ধতি (Administration of Homoeopathic Remedy) -
যেহেতু হোমিওপ্যাথিতে রোগের ওপর নয় রোগীর ওপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয় তাই আমরা দেখি একই রকম আক্রান্ত রোগে ২ জন রোগীর ২ রকম ওষুধ দেওয়া হয়। এটা হয়ত সাধারনভাবে অদ্ভুত বলে মনে হলেও হোমিওপ্যাথির এটাই সাধারণ নিয়ম। ব্যাপারটা আরও বিস্তারিত আলোচনা করা যাক –
যেমন ধরুন, 5 জন ব্যাক্তি জ্বরে আক্রান্ত হল। অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসারে সবার জ্বরের জন্য একইরকম ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। শুধু বয়স বা ওজনের তারতম্য অনুসারে ওষুধের পরিমাণ কমবেশি হয়। কিন্তু Homoeopathy তে এই পাঁচ জনের হয়ত দুজনের Bryonia Alb, একজনকে Aconite, বা কারো Rhus Tox ইত্যাদি ওষুধ লক্ষণ ভেদে প্রয়োগ হতে পারে।ব্যাপারটা এমন, জ্বরে হয়ত দেহে তাপমাত্রা সকলেরই আছে কিন্তু একজন প্রচুর জল পান করতে চাইছেন, অন্যজন একদমই জল পান করতে চাইছে না – অর্থাৎ এই যে পিপাসা এই লক্ষণ ভেদের জন্য হোমিওপ্যাথিতে দুজনের দুই রকম ওষুধ হবে।
হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আসলে কি ও কিভাবে তৈরি হয় –
হোমিওপ্যাথিতে বিভিন্ন ভেষজ, সাধারণ বস্তু, খনিজ পদার্থ এবং নানা রোগ নিঃসৃত পদার্থ থেকে ওষুধ প্রস্তুত করা হয় বিশেষ পদ্ধতি অনুসারে। তবে এইসব পদার্থের কোনটিই ওই ওষুধের মধ্যে স্থূলভাবে থাকে না, যা থাকে তা ওই পদার্থের শক্তিমাত্র। প্রথমে যে পদার্থের ওষুধ প্রস্তুত করা হবে তার নির্যাস বিশুদ্ধ অ্যালকোহোল, জল বা মিল্ক অফ সুগার ইত্যাদির মধ্যে মিশিয়ে বারবার ঝাঁকি দেওয়া হয় এক বিশেষ যন্ত্র দ্বারা। সেটা ভালভাবে সম্পূর্ণ মিশে গেলে সেখান থেকে কিছু পরিমান নিয়ে আবার নতুন করে বিশুদ্ধ অ্যালকোহোল, জল বা মিল্ক অফ সুগারে মিশিয়ে ঝাঁকি দেওয়া হয় । এইভাবে ওই পদার্থের আর কোন স্থূল অস্তিত্ত্ব থাকে না, থাকে তার শক্তি।
হোমিওপ্যাথিক ওষুধ এর শক্তি ও মাত্রা –
হোমিওপ্যাথিতে মূলত চার রকমের ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। যেমন –
১, মাদার টিংচার (Mother Tincture)
২, দশমিক পদ্ধতিতে প্রস্তুত ওষুধ (Decimal Scale of Potency)
৩, শততমিক পদ্ধতিতে প্রস্তুত নিম্ন শক্তির ওষুধ (Centesimal Scale of Low Potency) এবং
৪, সহস্রতমিক পদ্ধতিতে প্রস্তুত উচ্চ শক্তির ওষুধ ( Millesimal Scale of High Potency)
রোগের বয়স, রোগের গভীরতা, রোগীর বয়স এবং রোগীর জীবনী শক্তি অনুসারে অভিজ্ঞ চিকিৎসক কখন কোন শক্তি বা মাত্রার ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে তা নির্ণয় করে থাকে।
Note - ওপরের আলচনায় হোমিওপ্যাথিক সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে সাধারনের মধ্যে ভুল ধারনা দূর করা এবং এই চিকিৎসা পদ্ধতির উপকারী দিক গুলি সাধারনের মধ্যে তুলে ধরা এর উদ্দেশ্য। কখনই অন্য কোন চিকিৎসা পদ্ধতিকে ছোট করে দেখান বা হোমিওপ্যাথির প্রচার করা এই পোস্টের উদ্দেশ্য নয়। আপনি যে চিকিৎসা পদ্ধতিতে সুস্থ্য থাকেন বা যে চিকিৎসা পদ্ধতিকে বিশ্বাস করেন সেটাই আপনার নিকট উত্তম। চিকিৎসা পদ্ধতি পরিবর্তনের আগে সর্বদা আপনার চিকিৎসক এর সাথে পরামর্শ করুন বা নিজ দায়িত্বে করুন।
আরও পড়ুন 👉 তাশিরোজিমা - বেড়ালদের স্বর্গদ্বীপ।
জানা-অজানা - বিরাট এই পৃথিবী এক রহস্যের আধার। মানুষের গোচরে অগোচরে নানান সব অবাক করা ঘটনা। জানা-অজানার কলমে আমরা আমাদের প্রিয় পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই এইসব ঘটনার ইতিবৃত্ত। কেননা,আমরা মনে করি নির্ভেজাল জ্ঞানচর্চা আর অজানাকে জানা এক নির্মল আনন্দের সন্ধান দেয়। পর্বাকারে পরিবেশিত হবে আমাদের এই জানা-অজানার কলম। আজকের পর্ব নং - 04
Please do not enter any spam link in the comment box