রাত জাগার মারাত্মক 10টি কুফল

রাত জাগার মারাত্মক 10টি কুফল - নিয়মিত রাত জাগলে আপনার শরীরে কি কি মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে তার এক ঝলক আলোচনা করা হল

 সুস্থ-সবল থাকার সবথেকে সহজ-সরল নিয়ম হলো প্রকৃতির নিয়মগুলি যথাযথভাবে মেনে চলা, এর আর কোন বিকল্প হতে পারেনা। আমরা যারা প্রকৃতির নিয়মগুলি যথাযথভাবে মেনে চলতে পারি বা চলার চেষ্টা করি তারা অবশ্যই এর সুফল ভোগ করতে পারি, অন্যথায় ভুলের মাশুল গুনতে হয়। প্রকৃতির সাধারন নিয়মানুসারে জীবজগতের সকলের জন্য রাতকে নির্ধারন করা হয়েছে ঘুমের জন্য, আর এই ঘুমই হলো শরীরের সর্বোত্তম বিশ্রাম বা শরীরকে Relax করার একটি জৈবিক প্রক্রিয়া।


কিন্ত আমাদের অনেকেই অতিরিক্ত ভোগ বিলাস, লোভ ইত্যাদির বশবর্তী হয়ে এই নিয়ম লঙ্ঘন করে দিনের পর দিন রাতজাগা, অনেক রাতে আহার গ্রহন করা, Late Night Party-তে সময় কাটানো Night Club-তে যোগদান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যাই। যার ফলস্বরুপ নানান শারীরিক ও মানসিক সমস্যা আমাদের ঘিরে ধরে। তবে এটাও ঠিক যে, অনেককেই বেশ কিছু কারনের জন্য রাত্রি জাগরণ করতেই হয়- তবে সেটা অন্য ব্যাপার বা সাময়িক। কিন্তু যারা উপরে বর্ণিত কারনে রাত্রি জাগরণ করেন এবং সেটা অভ্যাসে পরিনত করে ফেলেন, তদুপরি সেই ঘাটতি মেটানোর জন্য দিনেও শরীরকে সময় বা সুযোগ দেন না – তাদের এর কুফল ভোগ করতেই হয়। নীচে বিস্তারিত আলোচনা থাকল।

 

১, চোখের নীচে কালি পড়ে ও চেহারার লাবন্য কমে যায় – 

দিনের পর দিন রাত জাগার সবথেকে বিরক্তিকর কুফল হল চোখের নীচে কালি পড়ে যায় ও আপনার মুখের লাবন্য এবং চেহারার কমনীয়তা কমে যেতে থাকে। শরীরে স্ট্রেস হরমোনের প্রভাব বাড়তে থাকে, আমাদের ত্বকের গঠন ধরে রাখে যে কোলাজেন ত্বকের অন্দরে সেই কোলাজেনের মাত্রা কমতে শুরু করার কারণে সৌন্দর্যও হ্রাস পায়। আপনি সহজেই খেয়াল করে থাকবেন যারা এভাবে রাত জাগেন এবং ঘুমের ঘাটতি হয় তাদের মুখের লুক স্বাভাবিক থাকেনা, কেমন যেন অপরাধী অপরাধী ভাব লাগে।

 

২, হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয় –   

দিনের পর দিন রাতে না ঘুমালে আমাদের হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। কেননা হৃদপিণ্ড শরীরের এমন একটি অঙ্গ যা কখনই তার কার্যকলাপ বন্ধ করেনা। শুধুমাত্র ঘুমানোর সময় এর কাজ খুব ধীরে ধীরে হয়, সেদিক থেকে দেখলে এসময়ই আমাদের হৃদপিণ্ড একপ্রকার ‘বিশ্রাম’ পেতে পারে। কিন্তু যদি আমরা আমাদের হৃদপিণ্ডকে সেই সুযোগটা না দিই – তাহলে আমাদের চেয়ে বোকামি আর কে করছে?! আর এই বিশ্রাম না পেয়ে প্রথমে আমাদের হৃদপিণ্ডের চলার ছন্দপতন ঘটে, আর তার সাথে ধীরে ধীরে এসে জোটে উচ্চ রক্তচাপ(High Blood Pressure) – যা নীরবে আরো অনেক রোগকে আমন্ত্রণ জানায়। অতএব সাবধান!!  

 

৩, দেহের জৈবিক ঘড়ির (Biological Clock) ছন্দপতন ঘটে –

মানব শরীরের যাবতীয় জৈবিক কার্যসমূহ একটি নির্দিস্ট ছন্দে এবং সময়ানুসারে ঘটে। আপনি খেয়াল করলে দেখতে পাবেন যে, একটি নির্দিস্ট সময়ে আপনার ঘুম, খিদে বা মল মূত্রের বেগ আসে। শরীরের এই ছন্দ এবং সময়ানুসারে জৈবিক কার্যসমূহ গুলো ঘটা সুস্থতার লক্ষণ। কিন্তু যদি আপনি আপনার রাতের ঘুম শরীরকে ফাঁকি দেন তাহলে খুব সহজেই শরীরের এই জৈবিক ঘড়ির()ছন্দ নস্ট হয়। ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যকলাপের পরিবর্তন হতে দেখা যায় এবং এরফলে আমাদের শরীরে নানারকম অস্বস্তি হতে থাকে – যা দীর্ঘমেয়াদি হলে রোগের জন্ম দেয়।

 

৪, শরীরে দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলির ক্ষেত্র তৈরি হয় –

রাত জাগার অভ্যাস বা রাতের ঘুমের ফাঁকি আমাদের নানান শারীরিক গোলযোগ ঘটায়। দেহের যন্ত্র বা তন্ত্রগুলি বিশ্রাম না পাওয়ার ফলে তাদের কার্যগত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে, এবং এই প্রক্রিয়া যদি দীর্ঘমেয়াদি তাহলে বিভিন্ন সব রোগ যেমন গ্যাস, অম্বল, কোস্টকাঠিন্য, মাথাধরা, বদহজম, অনিদ্রা, ইত্যাদি ছোটখাট সমস্যা তো হয়ই তার সাথে সাথে  গবেষণায় দেখা গেছে রাত ১১টার পর ঘুমাতে গেলে হার্টের রোগ এবং টাইপ- ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যেমন দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পায়, তেমনি আরও কিছু রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। তাছাড়া মস্তিষ্কের ওপর মারাত্মক চাপ পড়ে। যে কারণে ব্লাড প্রেসার বাড়তে থাকে এবং কিডনির যেমন মারাত্মক ক্ষতি হয়, তেমনি স্ট্রোক এবং দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ার মতো সমস্যাও বেড়ে যায়। তাই আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এদের আমন্ত্রণ জানাবেন না নিজে ঠিক থেকে এদের বিদায় করবেন। 


৫, ক্রমশ আয়ু কমতে থাকে – 

পৃথিবীর নানা প্রান্তের দীর্ঘজীবি  মানুষদের নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে প্রতেকটিতেই যে সব সাধারন তথ্য উঠে এসেছে তাহল, দীর্ঘদিন সুস্থ-সবলভাবে বাঁচার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দুশ্চিন্তামুক্ত অতি সাধারন সহজ-সরল জীবন যাত্রা, এর বেশিকিছু নয়। এই জীবনযত্রার অন্যতম উপাদান হল সুপাচ্য পরিমিত আহার, পরিশ্রম, ঘুম, সামাজিকতা ইত্যাদি। আর যদি আমরা এর মধ্যে ঘুমকে গুরুত্ব না দিই, দীর্ঘদিন ধরে রাত জেগে কাটাই, তাহলে শরীরের অন্যান্য জৈবিক ক্রিয়ার ওপর প্রভাব পড়বে বৈকি এবং সেই প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই সুফলদায়ক হবে না। অতএব দীর্ঘদিন সুস্থ-সবলভাবে বাঁচতে শরীরের প্রয়োজন ঘুমের – এর কোন বকল্প হতে পারে না।

 

৬, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয় পড়ে –

মেডিক্যাল বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে রাত জেগে কাজ করলে আমাদের দেহের হরমোনের ভারসাম্য নস্ট হয়ে যায়, শরীরের নানা অব্যবস্থার জন্য নানারকম স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ মারাত্মক বেড়ে যায়। আর এই স্ট্রেস প্রাথমিকভাবে আমাদের দেহের পাচনতন্ত্রকে আঘাত হানে এবং এর পর ধীরে ধীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে থাকেফলে নানাবিধ রোগ ঘাড়ে চেপে বসতে সময়ই লাগে না। স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি পেলে মানসিক চাপও বাড়তে শুরু করে, যা আমাদের শরীরের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক। 


৭, ওজন বৃদ্ধি পেতে শুরু করে –  

দিনের পর দিন রাতে না ঘুমালে আমাদের পাচনতন্ত্র-এ নানা গোলযোগ দেখা যায়। পাচনতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে খাবার ঠিক মতো হজম হতে পারে না। এরফলে একদিকে যেমন গ্যাস-অম্বলের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, তেমনি অন্যদিকে খাবার সঠিকভাবে পাচিত না হওয়ার ফলে ওজনও বাড়তে শুরু করে। আর ওজন বাড়লে ধীরে ধীরে সুগার, প্রেসার এবং কোলেস্টেরলের মতো মারণ রোগ এসে শরীরে বাসা বাঁধে। সুতরাং সাবধান!!


৮, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যেতে শুরু করে

 ঘুম হল মস্তিস্কের সবথেকে দরকারী জৈবিক প্রক্রিয়া। ঘুমের মধ্য দিয়ে মস্তিস্ক যেমন বিশ্রাম পায়, তেমনি মস্তিস্ক নিজেকে পুনরায় পরবর্তী কর্মের জন্য তৈরি করে নেয়। কোন ঘাটতি থাকলে পুষিয়ে নেয়। তাই দীর্ঘদিন ধরে রাতজাগলে মস্তিস্ক যেমন বিশ্রাম পায়না, তেমনি ধীরে ধীরে মস্তিস্কের  কার্য্যক্ষমতা কমতে শুরু করে। সেই সঙ্গে ডিপ্রেশন, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, স্লো কগনিটিভ ফাংশন, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়াসহ আরও সব নানান সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।এছাড়াও ঠিক মতো ঘুম না হলে মস্তিস্ক অশান্ত হয়ে থাকে ফলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়ে এবং এই কারণেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যায় কমে।


৯, কর্মোদ্যম কমে যায় -  

এটা স্বাভাবিক যে, আপনার শরীর যদি সুস্থ-স্বাভাবিক নীরোগ থাকে সকল কর্মে আপনি বেশ মনযোগী হতে পারবেন, আপনার দক্ষতা কর্মে বেশি করে দেখাতে পারবেন এবং আপনি সফল হবেন। অন্যদিকে যদি শরীর ও মন যদি বশে না থাকে তাহলে ব্যার্থ হবেন। সুতরাং এটা জরুরি যে, সারাদিন Active থাকতে ঘুমের দিকে আমরা নজর দিই।

 

১০, মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হয় – 

রাতে ঠিকমত ঘুম না হলে আপনার শরীরে অন্যান্য অঙ্গের মত হরমোন গ্রন্থিগুলোরও গোলযোগ দেখা দিতে পারে। ফলে হরমোনের স্বাভাবিক ক্ষরণ না হয়ে শরীরে তার ভারসাম্য নষ্ট হয়। এর ফলে আমাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়ে। তখন সহজেই রেগে যান, কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে পারেন না, কর্মে ভুলভ্রান্তি হয় – এরুপ সমস্যা নিত্যদিনের হয়ে দাঁড়ায়। ফলে পারিবারিক ও কর্ম জীবনে ব্যাপক প্রভাব পড়ে, শারীরিক ও মানসিক শান্তি ব্যাহত হয়।  

 

Note- উপরিউক্ত আলোচনার বিষয় সম্পুর্ন সাধারন তথ্যমূলক আলোচনা( General Informative Discussion) মাত্র। সাধারন মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ-সরল-সুন্দরভাবে গড়ে তোলার একটি প্রয়াস মাত্র। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, সমাজ-সংসার-দেশ-শাসনব্যবস্থার যাত্রা সচল রাখতে অনেকেকেই রাত্রি জাগরণ করতেই হয়, কিন্তু তাদের অনুৎসাহিত করার কোন প্রয়াস এই আলোচনার উদ্দেশ্য নই। কেননা আমরা জানি এইসব কর্মে লিপ্ত থাকা ব্যাক্তিরা স্বাভাবিকভাবেই তাদের ঘুমের চাহিদা দিনের বেলা মিটিয়ে নেন এবং বেশ সুস্থ-সুন্দর থাকেন। তাই তাদের জীবনযাত্রা সুস্থ-সুন্দর, তাদের স্বাস্থ্য বজায় থাকুক এই কামনা করি।

 

 

 

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.